প্রাকৃত সমাজের ডাক
পৃথিবীর মাটি, পানি ও বাতাসকে দূষিত করে এমন কোনো কাজ মানুষ করতে পারবে না। সর্বপ্রাণের একটিমাত্র প্রাণ হিসেবে মানুষের কোনো অধিকার থাকা নিশ্চয়ই ঠিক হবেনা যে – তার কৃতকর্মের ফল অন্য সকল প্রাণকে ভোগ করতে হবে! আপনারা সকলেই জানেন যে মানুষের কর্মফলের কারনে পৃথিবী থেকে ইতিমধ্যেই বহু প্রাণের বিলুপ্তি ঘটেছে! অথচ আমরা সবাই মনে মনে মানি যে মানুষ একা একা বাঁচতে পারবে না। তারপরেও আমাদের কর্মে তার প্রতিফলন নাই! সভ্যতার দোহাই দিয়ে, উন্নয়নের নামে নিজেদের আরাম আয়েশের জন্য আমরা আমাদের সন্তানদের জন্যই এক মৃত্যুপুরী বানিয়ে রেখে যাচ্ছি পৃথিবীটাকে! যেই চাকচিক্যময় উন্নয়নের ঘোরে চলছে মানুষের দল এভাবে যদি আর মাত্র দশ বছরও চলে, তাহলেই বর্তমানে যে প্রাণবৈচিত্র অবশিষ্ট আছে পৃথিবীতে তার অর্ধেকও থাকবে না! অথচ পৃথিবীতে প্রাণবৈচিত্র না থাকলে মানুষও স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারবে না। তো আপনি একজন মানুষ হিসেবে এই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎকে রুখে দিতে কি ভূমিকা পালন করছেন? আপনার সন্তানদের কোন পৃথিবীতে রেখে যেতে চাইছেন?
আপনাকে দায়ীত্বটুকু নিতে হবে। অন্তত খুব করে চেষ্টা করতে হবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে! অন্য প্রাণের ক্ষতি সাধন করে এমন জীবন যাপন করা থেকে আমাদের দ্রুত বের হয়ে আসতে হবে। যারা এখনি পারবে না, তাদেরকে সৎ ভাবে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে যাতে দ্রুততর সময়ের মধ্যে তারাও প্রাকৃত জীবন যাপন শুরু করতে পারেন। প্রাকৃত জীবন যাপন বলতে আমরা বুঝি – প্রকৃতিকে জয় করে নয়, প্রকৃতির অংশ হয়ে বাঁচা। আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে এমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে এসে প্রকৃতির মঙ্গল হয় এমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া। কিন্তু বর্তমানে এই ধরনের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আমাদের পক্ষে নয়। এমতাবস্থায় আপনি একা একা প্রাকৃত জীবন যাপন শুরু করতে অনেক বেশি কষ্ট হবে। কিছুদিন পারলেও একটা সময় গিয়ে হাঁপিয়ে উঠবেন, পারবেন না!
কারন আপনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সর্বত্র হাতছানি দিচ্ছে – পূঁজিবাদ! ভোগ! বর্তমানে বাঁচো নীতি! এইসকল আপাত লোভনীয় আহবানকে দূরে ঠেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের মানসিকভাবে যতটা শক্তিশালি হতে হবে, একা একা সেই শক্তি অর্জন করা অনেক কঠিন। তাহলে করণীয়?
আমাদেরকে বিদ্যমান সমাজ/রাষ্ট্রের ভেতরেই সমমনা মানুষদের নিয়ে প্রথমে এমন একটা সমাজ বিনির্মাণ করা শুরু করতে হবে যেখানে অন্যান্যরা একসময় আমাদের সাথে যোগ দিতে বাধ্য হবে। মন থেকেই। আমি এমন একটা সমাজের নাম প্রস্তাব করছি – “প্রাকৃত সমাজ”। যা একসময় ছিলোই। কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি! কিন্তু স্মৃতি এখনো স্পষ্ট। যা আমাদের আবার পূন:রুদ্ধার করতে হবে!
প্রাকৃত সমাজ ব্যবস্থায় পৌছাতে হলে মানুষের প্রাথমিক কাজ হবে – পৃথিবীর মাটি, জল ও বাতাসকে দূষিত না করে একটা প্রাকৃত জীবন নির্বাহ করার পথ খুঁজে বের করে সেই পথে এগিয়ে যাওয়া। আমরা আপনাকে আহবান করছি – চলুন অন্তত আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হলেও একসাথে জড়ো হই। একে অন্যের হাত ধরাধরি করে বাঁচি। সর্বপ্রাণের সমাজ পূণ:প্রতিষ্ঠা করতে মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্বটুকু পালন করি।
প্রাকৃত সমাজের অংশ হতে হলে আমাদেরকে নিয়মিত প্রাকৃত সমাজ পাঠ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে এবং প্রাথমিকভাবে নিচের শর্তগুলো মানতে হবে –
১. আপনাকে অবশ্যই পৃথিবীর সকল ধর্মের, বর্ণের, জাতির, গোত্রের, শ্রেনীর মানুষকে এবং অন্যান্য সকল প্রাণ ও অপ্রাণকে ভালোবাসতে হবে।
২. একটি প্রেমের সমাজ তৈরী করার প্রধান শর্তগুলোর অন্যতম হলো – যত কম জিনিস নিয়ে বাঁচা যায়, প্রকৃতির জন্য তত মঙ্গল। আর প্রকৃতির মঙ্গল ভিন্ন প্রেমের সমাজ/দেশ/পৃথিবী গড়া অসম্ভব। প্রেম ছাড়া, ভালোবাসা ছাড়া প্রাকৃত জীবন যাপন সম্ভব নয়, প্রাকৃত সমাজের কথা তো ভাবাই যাবে না! সুতরাং যদি সকলের জন্য প্রেম-ভালোবাসা মনে থাকে, প্রাকৃত সমাজে আপনাকে স্বাগতম।
৩. প্রাকৃত সমাজের সদস্যরা বিষমুক্ত জীবন যাপনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। প্রথমেই – আমাদের খাদ্য তালিকা থেকে বিষ বাদ দিতে হবে! প্রাকৃত সমাজের প্রত্যেককেই বিষমুক্ত উপায়ে নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। কিছুটা হলেও। নগরে যারা বসবাস করছে তাদেরকেও শুরু করতে হবে। তবে নগর জীবন যাপনের কারনে যেহেতু একটি পরিবারের সকল খাদ্য নিজে উৎপাদন করতে পারবে না, সেহেতু প্রাথমিকভাবে অবশ্যই আমাদের প্রাকৃত সমাজের সদস্য যেকোনো প্রাকৃতিক কৃষিপণ্য বিপনণকারীর কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব হলো প্রাকৃত সমাজের সদস্যগণ অন্যান্য সাধারণ ক্রেতাদের থেকে নূনতম ৫% কম মূল্যে প্রাকৃতিক কৃষির খাদ্য সংগ্রহ করতে পারবে।
৪. আমরা যারা প্রথমেই উৎপাদক হতে পারবো না, তারা অন্তত সচেতনভাবেই আয়-রোজগারের অংশ হিসেবে এবং প্রাকৃতিক কৃষিপণ্য সকলকে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে দেশব্যাপী প্রাকৃত সমাজের বিপনণ চেইনে অংশ নিতে পারবো। এতে করে সংসার খরচ চালানোর জন্য নূনতম আয়ের পাশাপাশি সারা দেশে প্রাকৃতিক কৃষির খাদ্য পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রেও আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা হবে। মনে রাখতে হবে – খাদ্য উৎপাদনকে যদি আমরা পরিবেশবান্ধব এবং সর্বপ্রাণের জন্য মঙ্গলজনক না করি তাহলে বাকী সকল চেষ্টা বৃথা!
৪. দেশের সকল জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাকৃত জীবন যাপনের গুরুত্ব তুলে ধরার অংশ হিসেবে প্রাকৃত সমাজের গবেষণা, প্রযোজনা, সৃষ্টি ও প্রচারণা টিমের তৈরীকৃত বক্তব্য (ভিডিও/অডিও কনটেন্ট, যেকোনো ইমেজ, লেখা, শিল্প) সম্মিলিতভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা যদি প্রাকৃত জীবনের পাঁচটি প্রধান ক্ষেত্র – খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে ধীরে ধীরে প্রাকৃত সমাজের প্রাত্যহিক চর্চায় নিয়ে আসতে পারি, তবেই কেবল আমাদের সন্তানদের জন্য তথা সর্বপ্রাণের জন্য দূষণমুক্ত, বিষমুক্ত ও বাসযোগ্য একটা পৃথিবী রেখে যেতে পারবো। আমরা শুরু করবো খাদ্য দিয়ে। আমাদের প্রথম লক্ষ্য হলো যত দ্রুত সম্ভব আমরা বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষকে বিষমুক্ত খাদ্য উৎপাদন, বিপনণ ও গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা। আর সেটা করতে হলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের মনে রাখতে হবে যে – প্রাকৃতিক কৃষি পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদন ও বিপনণের সাফল্য নির্ভর করবে দেশব্যাপী বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য ভোক্তা কি পরিমান বাড়লো তার উপর। আর পৃথিবীর প্রাণ-বৈচিত্র রক্ষা করতে হলে খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া হিসেবে প্রাকৃতিক বা জৈব কৃষির কোনো বিকল্প নাই সেটা আমরা সকলেই জানি। তাই যেকোনোভাবেই হোক আমাদেরকে পূঁজিবাদী কোম্পানি নির্ভর ভোক্তাদেরকে প্রাকৃত সমাজের অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। আর এই কাজে সফল হতে হলে আমাদের সবাইকে আন্তরিকভাবে একত্রে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
৫. প্রাকৃত জীবন যাপন ছাড়া প্রাকৃত সমাজ গঠন সম্ভব নয়। সে হিসেবে বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বিপনণ ও গ্রহণ নিয়ে কাজ শুরু করলেও কিছুদিন পর থেকেই আমরা পরিবেশবান্ধব বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ইত্যাদি সেক্টরগুলো নিয়েও কাজ শুরু করতে চাই।
প্রাকৃত সমাজের একজন সদস্য হিসেবে আপনি যে শুধুমাত্র দেশের একজন সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব পালন করবেন তা নয়, আপনি নিজে, আপনার পরিবার এবং আপনার সন্তানদের একটি সবুজ পৃথিবীতে বাকী জীবনটা কাটানোর সুযোগ তৈরীর ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবেন।
আগামী ২২ আগস্ট, ২০২৫, শুক্রবার, আমরা শাহবাগের পরিবাগ, সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে, বিকাল ৩ টায়, আপনার জন্য অপেক্ষা করবো। আপনি যদি একজন প্রাকৃতিক কৃষক হোন, প্রাকৃতিক কৃষি সংগঠক হোন, প্রাকৃতিক কৃষি বিপনণকারী হোন, নূনতম একজন ভোক্তা হোন, পরিবেশবান্ধব স্থপতি হোন, পরিবেশবান্ধব চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হোন, শিল্পী হোন কিংম্বা পরিবেশবান্ধব একটা সমাজ বিনির্মাণে তীব্র আগ্রহী মানুষ হোন, আমন্ত্রণ রইলো। আসুন আমরা একসাথে কাজ শুরু করি। একসাথে সর্বপ্রাণকে সাথে নিয়ে বাঁচি।
আহবায়ক
প্রাকৃত সমাজকর্মীগণ
০১৯৩২৮৭০৩৪০